৪০ বছর আগের কথা। অভাবের তাড়নায় ট্রেনের ভেতর রেখে আসা হয় দুই বোন সাজেদা ও মল্লিকাকে। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় ট্রেন থেকে মাতৃসদন, সেখান থেকে দুই শিশুর আশ্রয় মেলে সুদূর নেদারল্যান্ডসের দুই দম্পতির ঘরে।
নানা নাটকীয়তার পর গতকাল সোমবার স্বামী-সন্তান নিয়ে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে উপজেলার খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের জন্ম ভিটায় স্বজনদের ফিরে পান ছোট বোন সাজেদা।
১৯৭৮ সালের কথা। গফরগাঁও উপজেলার খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের হতদরিদ্র ইন্তাজ আলী আর তার স্ত্রী সমতা বেগমের ঘরে তখন দারুন অভাব। সন্তানদের ভরণপোষণের সামর্থ্য তাদের নেই। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে দুই শিশু কন্যা সাজেদা ও মল্লিকাকে রেখে আসেন গফরগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে। বিস্কিট ও চকোলেট আনার কথা বলে চলে যান তারা। আর ফেরেননি। পরে ট্রেনটি টঙ্গী স্টেশনে দাঁড়ালে দুই শিশুর কান্না দেখে স্থানীয় এক ব্যক্তি তাদেরকে ট্র্রেন থেকে নামিয়ে দত্তপাড়ায় অবস্থিত একটি মাতৃসদনে ভর্তি করে দেন।
এর দুই বছর পর ১৯৮০ সাল। নেদারল্যান্ডসের এভার্ট বেকার ও মেরিয়ান্ট রেজল্যান্ড দম্পতি তখন বাংলাদেশ সফর করছেন। তারা টঙ্গীর ওই মাতৃসদন থেকে শিশু মল্লিকাকে দত্তক নেন। পরে ওই দম্পতির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের আরেকটি পরিবার মল্লিকার ছোট বোন সাজেদাকে দত্তক নেন। সেখানেই বড় হন সাজেদা ও মল্লিকা।
দুই বোনের মাতৃভূমি যে বাংলাদেশ- দত্তক নেওয়া পরিবারের কাছে এ খবর জানতে পারলেও প্রকৃত আত্মপরিচয় জানতে পারেননি তারা। পরে আত্মপরিচয়ের খোঁজে দুই বোন একাধিকবার বাংলাদেশ ঘুরে গেলেও তাদের আত্মপরিচয় জানাতে পারেনি কেউ।
এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় এমনকি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর সূত্র ধরে অনেকেই তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যম এমনকি ইত্যাদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এর মধ্যে গফরগাঁও থেকে যোগাযোগ করেন সাজেদা ও মল্লিকার স্বজনরাও। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে সাজেদা ও মল্লিকার প্রকৃত পরিচয় উন্মোচিত হয়।
গতকাল সোমবার বিকেলে ইত্যাদি’র একটি দলের সঙ্গে মল্লিকা তার স্বামী ও দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে ভাই-বোন ও স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেন খারুয়া মুকুন্দ গ্রামের জন্ম ভিটায়। মল্লিকা বাংলা বলতে পারেন না। পরে তারা বাবা-মার কবর জিয়ারত করেন। এ সময় এক আবেগঘন অবস্থার সৃষ্টি হয়।
বড় বোন সলেমন নেসা ও ভাই ছুতু মিয়া হারিয়ে যাওয়া বোনকে পেয়ে আবেগে জড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করেন। খবর পেয়ে স্থানীয় সংবাদকর্মীরা ছুটে এলেও এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে বা সংবাদ প্রকাশ করতে অনিহা প্রকাশ করেন তারা।
মল্লিকার ভাই ছুতু মিয়া বলেন, ‘অত বছর পরে বইনেরে ফিইরা পাইছি, খুব ভালা লাগতাছে। কিন্তু খারাপ লাগতাছে বাবা-মার লাইগ্যা। তারা যুদি বাইচ্চা থাকতো!’
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সাহাবুল আলম বলেন, ‘বিষয়টি খুবই আবেগের। ফিল্মে দেখা যায় হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে বহু বছর পর ফিরে পেতে। কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটবে এটা ভাবতেও পারিনি।’